শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : কক্সবাজারে প্রশাসনের নাকের ডগায় ‘মসজিদ নির্মাণের’ ব্যানার সাটাই করে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতির সরকারি জায়গা জবর দখল তৈরী করল মার্কেট।
এমন কি প্রস্তাবিত কথিত মসজিদ নির্মাণের জন্য স্থানীয় বিশিষ্টজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মোটা অংকের টাকাও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সমিতির দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এ নিয়ে গত ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্টরা কক্সবাজার সদর থানায় জিডি’র পাশাপাশি জেলা প্রশাসক ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এছাড়া চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কক্সবাজার জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি দল অভিযান চালিয়ে ঘটনার সত্যতা পায়। পরে দলটির নেতৃত্ব দানকারি দুদকের সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন প্রধান কার্যালয়ে সরকারি জমি উদ্ধারে সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন প্রেরণ।
তবে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন ধরণের নির্দেশনা আসেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার শহরের শহীদ সরণিস্থ জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে রাস্তার পাশে গণপূর্ত বিভাগের মালিকানাধীন ৭ শতক জমি রয়েছে। ওই জমি গত ২০ বছর ধরে অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি।
গত বছর নভেম্বর মাসে দখলকৃত ওই জায়গায় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি পাকা স্থাপনার বহুতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু করলে গণপূর্ত বিভাগ আপত্তি জানায়। এখন সেখানে পাকা স্থাপনার মার্কেট নির্মাণ করে বিভিন্ন লোকজনের নিকট দোকান ভাড়া দিয়েছে। আর প্রতিটি দোকান ভাড়ার চুক্তি বাবদ প্রতিজনের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা।
এ নিয়ে গণপূর্ত বিভাগ কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান এর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টির ব্যাপারে অবগত নন বলে জানান।
তবে এ ব্যাপারে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে আরিফুর রহমান বলেন, কক্সবাজার শহরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পাশে গণপূর্ত বিভাগের মালিকানাধীন কিছু পরিমান জায়গা দীর্ঘ বছর ধরে অবৈধভাবে ভোগদখলে রেখেছে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি। গত বছর নভেম্বর মাসে সমিতির উদ্যোগে সেখানে পাকা স্থাপনার বহুতল ভবন নির্মাণকাজ শুরু করে।
বিষয়টি নজরে এলে গণপূর্ত বিভাগ আপত্তি জানায়। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি আপত্তি অমান্য করে বহুতল ভবনের পাকা স্থাপনা নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে।
” গত বছর ৩০ নভেম্বর আমি বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় অবৈধভাবে সরকারি জায়গা দখলের অভিযোগে সমিতির বিরুদ্ধে একটি জিডি করেছি। এরপর জায়গা থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি। ”
গণপূর্ত বিভাগের এ কর্মকর্তা বলেন, ” ইতিমধ্যে দখলকৃত জায়গায় বহুতল ভবনের এক তলা পাকা স্থাপনার মার্কেট নির্মাণকাজ শেষ করেছে জেলা চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি। মার্কেটে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নির্মিত দোকান ঘর বিভিন্ন লোকজনের কাছে ভাড়াও দিয়েছে। “
” অভিযোগ জানানোর অন্তত ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও জেলা প্রশাসন ও কউক কর্তৃপক্ষ কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি। এমন কি থানা পুলিশও ঘটনার ব্যাপারে কোন ধরণের প্রতিবেদন দেননি ” বলে অভিযোগ গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় আরিফুর রহমান।
সচেতন মহল ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গণপূর্ত বিভাগের মালিকাধীন সরকারি মূল্যবান জায়গা দখলে নিতে জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি বহুতল ভবন নির্মাণে অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ভবনটির নির্মাণকাজ শুরুর আগে সমিতির উদ্যোগে বিরোধীয় জায়গায় ‘মসজিদ স্থাপনের’ ব্যানার সাটাই করে। এমন কি সমিতির দায়িত্বরতরা মসজিদ নির্মাণের নামে স্থানীয় বিশিষ্টজনের কাছ থেকে অনুদানের নগদ টাকাও সংগ্রহ করেছে।
কিন্তু সরকারি ওই জায়গায় মসজিদ স্থাপিত না হলেও নির্মিত হয়েছে বাণ্যিজিক বহুতল ভবনের মার্কেট। এখন ওই মার্কেটের দোকানগুলো মোটা অংকের টাকায় চুক্তি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
গত বছরখানেক আগে সমিতির উদ্যোগে প্রস্তাবিত কথিত মসজিদের জন্য অনুদান প্রদানকারি স্থানীয় সমাজকর্মি সরওয়ার আলম বলেন, জেলা চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতির দায়িত্বরতরা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পাশের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য তার কাছে অনুদানের সহায়তা চান। তিনি প্রাথমিকভাবে অনুদান বাবদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন।
” কিন্তু পরে জানতে পারি, মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটি গণপূর্ত বিভাগের মালিকাধীন। আর জায়গার মালিকানা নিয়ে সমিতির সঙ্গে গণপূর্ত বিভাগের বিরোধ রয়েছে। মূলতঃ বাণ্যিজিক বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য মসজিদ স্থাপনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে প্রতারণার উদ্দ্যেশে। “
প্রস্তাবিত কথিত মসজিদে অনুদান দেওয়া এ সমাজকর্মি বলেন, ” জেলা চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবনা দিয়েছে আরও অনেকের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছেন। প্রস্তাবিত মসজিদের জায়গায় এখন নির্মিত হয়েছে বহুতল বাণ্যিজিক ভবন। আর সমিতির দায়িত্বরতরা মসজিদ নির্মাণের নাম করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করেছে আত্মসাত করেছে। “
মসজিদ স্থাপনের প্রস্তাবনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাণ্যিজিক ভবন নির্মাণ এবং অনুদান সংগ্রহ করে আত্মসাতের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন সরওয়ার আলম।
এদিকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারী সরকারি মূল্যবান জায়গা দখল করে বহুতল বাণ্যিজিক ভবন নির্মাণের অভিযোগে দুদকের কক্সবাজার জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিনের নেতৃত্বে এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি দল অভিযান চালায়। এসময় দুদকের দলটি জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতির উদ্যোগে ঘটনার সত্যতা পায়।
এ নিয়ে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, কক্সবাজার শহরে পুলিশ সুপার কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায় জেলা চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতির উদ্যোগে সরকারি জায়গা দখল করে বাণ্যিজিক বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগে দুদকের একটি দল অভিযান চালিয়েছিল। এতে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে জায়গা দখলের অভিযোগের সত্যতা পায়।
” এর পরপরই জেলা চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতির উদ্যোগে নির্মিত ও নির্মাণাধীন সবধরণের স্থাপনা উচ্ছেদ করে সরকারি জায়গা উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সুপারিশ আকারে একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছিল। “
কিন্তু প্রতিবেদন পাঠানোর প্রায় ৭ মাস অতিক্রান্ত হলেও দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোন ধরণের নির্দেশনা পাননি বলেন দুদকের এ সহকারি পরিচালক।
অভিযোগের ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বলেন, অভিযোগের ব্যাপারে তিনি কোনভাবেই জড়িত নন। প্রস্তাবিত মসজিদ ও মার্কেট নির্মাণের জন্য সমিতির উদ্যোগে সভাপতি সহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে।
সমিতির ওই কমিটির সদস্যরাই এ ব্যাপারে অভিযোগের ব্যাপারে সত্যাসত্য ভাল বলতে পারেন বলে জানান কর্মচারি সমিতির এ কর্মকর্তা।
তবে অভিযোগের ব্যাপারে সমিতির সভাপতির সঙ্গে কথা বলতে প্রতিবেদককে পরামর্শ দেন আবুল হাশেম।
এদিকে সরকারি জায়গা দখল করে জেলা প্রশাসনের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারি সমিতি কর্তৃক বহুতল বাণ্যিজিক ভবন নির্মাণের অভিযোগের ব্যাপারে কথা বলতে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ এর মোবাইল ফোনে একাধিক কল দেওয়া হলেও কোন ধরণের সাড়া দেননি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply